1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

গণহত্যার সাড়ে ১৭ হাজার নিদর্শন এবার ডিজিটাল ম্যাপে

নিউজ এডিটর : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতায় নিহত বাঙালির সংখ্যা কত? স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও এ নিয়ে সরকারি উদ্যোগে হয়নি বস্তুনিষ্ঠ কোনো গবেষণা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছেও নেই এর সদুত্তর।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত হলেও তা এক মলাটে উঠে আসেনি কখনও। তবে এই প্রথম দেশের ৪২টি জেলা জরিপে পাওয়া তথ্যাদি নিয়ে ‘গণহত্যার জরিপ ও ডিজিটাল ম্যাপ’ প্রকাশ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণহত্যা জাদুঘর। ম্যাপে এখন পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫৪টি গণহত্যার নিদর্শন, যা গণহত্যার ঘটনা সম্পর্কে আগের হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে।

ডিজিটাল ম্যাপে গণহত্যার স্পটের পাশাপাশি গণকবর, বধ্যভূমি, নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন বর্ণনাসহ চিহ্নিত করা হয়েছে, যার সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ২০ হাজার ৬৯১টি। যে কেউ http://mapsgenocidemuseumbd.org লিঙ্কে গিয়ে একাত্তরের গণহত্যার স্পটগুলোতে ক্লিক করে তথ্যাদি দেখতে ও জানতে পারেন। গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রগুলো বিভিন্ন রঙে চিহ্নিত করা আছে। এটি হতে পারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য অনন্য তথ্যভান্ডার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের উদ্যোগে ২০১৪ সালের ১৭ মে ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী’ খুলনায় প্রতিষ্ঠা করে ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, যা গণহত্যা জাদুঘর নামে পরিচিত। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়; পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। গণহত্যার ডিজিটাল ম্যাপ প্রসঙ্গে জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও গণহত্যার তথ্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করাই স্বাধীনতাবিরোধীদের উদ্দেশ্য। অথচ মুক্তিযুদ্ধ শুধু বিজয়গাথা নয়; এটি বেদনারও। তাই মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা-নির্যাতন সম্পর্কে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এজন্য সারাদেশে জরিপ করা দরকার, যেটা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও হয়নি। গণহত্যা জাদুঘর সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।’ তাঁর মতে, ডিজিটাল ম্যাপ প্রণয়ন শেষ হলে আর কেউ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা নিয়ে ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক সুকুমার বিশ্বাস রচিত ‘একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর’। ওই গ্রন্থে ৫৪০টি গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এর পর ২০১২ সালে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ প্রকাশিত হয়। ১২ খণ্ডে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ কোষের তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯০৫টি গণহত্যার নিদর্শন চিহ্নিত হয়েছে। তবে গণহত্যা জাদুঘরের চলমান জেলা জরিপের তথ্য পাল্টে দিচ্ছে গণহত্যার আগের সব হিসাবনিকাশ।

জানা গেছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ২০১৭ সালে দেশের ৬৪ জেলায় গণহত্যা-গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র সম্পর্কে জরিপ পরিচালনার কাজ শুরু করে গণহত্যা জাদুঘর। এর আওতায় ইতোমধ্যে ৪২টি জেলার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশের পাশাপাশি ডিজিটাল ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অপর ২২ জেলায় জরিপ কাজ শেষ হলেও তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ ও ডিজিটাল ম্যাপিং হয়নি। চলতি বছরের মধ্যে ওই ম্যাপিং শেষ হওয়ার কথা। জরিপ ও ম্যাপিংয়ের কাজে জাদুঘরের পক্ষে সারাদেশে প্রায় ৭০০ গবেষক ও কর্মী যুক্ত আছেন।

জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী, ডিজিটাল ম্যাপে ৪২টি জেলায় জরিপ করে পাওয়া ১৭ হাজার ৪৫৪টি গণহত্যা, ৮৫৫টি বধ্যভূমি, ১ হাজার ২৬৪টি গণকবর ও ১ হাজার ১১৮টি নির্যাতনকেন্দ্র বর্ণনাসহ শনাক্ত করে চিত্র আকারে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাপে চিহ্নিত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সুকুমার বিশ্বাস ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থে উল্লিখিত পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার নিদর্শনগুলো। জরিপের প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলায় ৩০ হাজার স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যেতে পারে।

জাদুঘরের ওয়েবসাইটের লিঙ্কে গিয়ে দেখা যায়, ম্যাপের ভেতর যে কোনো পিনের ওপর কার্সার রেখে ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে একটি বক্স ওপেন হয়। সেখানে স্পটের একটি ছবি ফুটে ওঠে। ছবিতে আরও একটি ক্লিক করলে আরও একটি ট্যাব ওপেন হয় এবং সেই স্থানে ঘটে যাওয়া গণহত্যা অথবা নির্যাতনের ঘটনার বিস্তারিত জানা যাচ্ছে। এখানে প্রতিটি বিষয়বস্তু আলাদা করে প্রদর্শন করা হয়েছে। রয়েছে গণহত্যা জাদুঘর এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনাও।

গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার ১২৬টি স্থানে ঘটে যাওয়া একাত্তরের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর নিয়ে ১২৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জীবনী, মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় বাহিনী ও শরণার্থীদের নিয়ে পৃথক গ্রন্থ। গণহত্যার ডিজিটাল ম্যাপ ইতোমধ্যে গুগল ম্যাপে যুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রম সফল হলে গুগল ম্যাপের সহায়তায় বাংলাদেশের গণহত্যার তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।

গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব ড. চৌধুরী শহীদ কাদের বলেন, ‘দেশের মানুষ নিজ এলাকার গণহত্যার তথ্য জানে না। ৪২টি জেলার এখন যে কেউ জাদুঘরের ওয়েবসাইটে গিয়ে তার নিজ এলাকার তথ্য জানতে পারছেন। অপর ২২টি জেলায় জরিপ শেষ হয়েছে। তথ্যসমূহ গণহত্যার ডিজিটাল ম্যাপে প্রকাশের কাজ চলছে।’ তিনি জানান, অত্যাধুনিক জিপিএসের (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) সহায়তায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করে নিখুঁতভাবে একাত্তরের স্মৃতিচিহ্নগুলো বিস্তারিত বিবরণসহ তুলে ধরা হয়েছে ইন্টার-অ্যাকটিভ ম্যাপে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহ রয়েছে। এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় তাদের আগ্রহ ধরে রাখা যাচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে একাত্তরের গণহত্যা পড়ানো হচ্ছে। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশে ২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র খোলা হয়। নোয়াখালীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণহত্যা বিষয়টি পড়ানো হয় না। তবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ২০১৪ সালে ‘সেন্টার ফর স্টাডি অন জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস কোর্স’ এবং গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ২০১৭ সালে ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১’ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ট্রেনিং (পিজিটি) কোর্স চালু রয়েছে। যার মধ্যে গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ১২টি ব্যাচে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার জনকে। এ ছাড়া গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ ফেলোশিপ চালু হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে গণহত্যা নিয়ে এখনও দৃশ্যমান কোনো গবেষণা কাজ শুরু হয়নি।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘গণহত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য নানাভাবে ছড়িয়ে আছে। এগুলো অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। যেটা গণহত্যা জাদুঘর সারাদেশে জরিপের পর অনলাইনে প্রকাশ করছে। বাংলাদেশে এটি প্রথম। তরুণ প্রজন্ম যারা অনলাইনে সক্রিয় থাকে তাদের জন্য এটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যে অনেক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণহত্যা নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। গণহত্যা জাদুঘরের জরিপে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা গবেষণা কাজেও সহায়ক হবে। সার্বিকভাবে এসব গবেষণা ও জরিপ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে। পাকিস্তানসহ যেসব দেশ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে অস্বীকার করে, তাদের জন্য এসব কর্মযজ্ঞ উপযুক্ত জবাব।’

গণহত্যার গবেষণা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকার তৎপর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে বেসরকারি পর্যায়েই বেশি কাজ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে। সরকার তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায়।’ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ