1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আমরা একজন স্বপ্নবাজকে হারালাম

আবদুর রহিম হারমাছি : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২

মুহিত স্যার আর নেই। গভীর রাতে যখন খবরটা পেলাম প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কয়েকদিন আগেই তো সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন স্যার। স্যারের সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাচ্চুকে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হলাম স্যার সত্যিই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।

খবরটা নিশ্চিত হওয়ার পর স্যারকে নিয়ে অফিসে রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে কিছুই লিখতে পারছিলাম না। বার বার স্যারের শিশুর মতো মায়াভরা সদা হাস্যোজ্জল মুখটি ভেসে উঠছিল। অনেক অনেক স্মৃতি স্যারের সঙ্গে।

টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট দিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করে গেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের এই যে এগিয়ে চলা তার অন্যতম প্রধান কারিগর মুহিত স্যার।

একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন মুহিত স্যার। যে স্বপ্ন তিনি বাংলাদেশকে দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নের জাল বুনেছেন সাহস, মেধা, অভিজ্ঞতা আর দেশপ্রেম দিয়ে। ৮৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট তিনি শেষ করেছিলেন ৫ লাখ কোটি টাকায় নিয়ে গিয়ে।

রাজস্ব আদায় বা কর বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তিনি দেখিয়েছেন চমক। তার সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের সুফল পাচ্ছে দেশবাসী।

গত ২৫ জানুয়ারি আবুল মাল আবদুল মুহিত পা দিয়েছিলেন ৮৯ বছরে। একটি পরিতৃপ্ত, কর্মবহুল ও বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে তিনি অবসর যাপন করছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বহুমাত্রিক মানুষটি কয়েক মাস আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ হলেও শারীরিক দুর্বলতা ছিল।

দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এ মানুষটি বাংলাদেশের উন্মেষ ও রূপান্তরের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ- এমন নানা পরিচয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ও সমৃদ্ধিতে তিনি এক রূপান্তরের নায়ক। ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন এই আলোকিত গুণীজন একজন ন্যায়নিষ্ঠ, সজ্জন চিৎপ্রকর্ষবিদ। সরলতা, সততা ও সত্য কথনে তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি।

১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন তিনি। বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী। দুইজনই রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন। সংস্কৃতিমনা পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা মুহিত কৈশোরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। শিশু-কিশোর সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’ গঠন করে নেমে পড়েন সৃজনশীল চর্চায়। আটাশি বছর বয়সেও তার সৃজনশীল চর্চা থেমে থাকেনি।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে স্কুল ছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন।

চাকরিরত অবস্থায় মুহিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগ দেয়ার পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন। তবে এই দায়িত্ব গ্রহণ না করে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকনোমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালে মুহিত এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এ পদে আসীন হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।

ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১- এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি সার্বক্ষণিক দেশে অবস্থান করে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের সুশীল সমাজের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃৎ এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০০১ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন তিনি। ২০০৯ সালে সিলেট -১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন।

অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তিনি নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। ২০১৪ সালে সিলেট-১ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি আবারও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে আর নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল কর্মযোগী, ধ্যানী, ধীমান এই মানুষটির স্পষ্টতা, সরলতা ও সাহসিকতা সব মহলে প্রশংসিত। লেখক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিষয়ে তার ‘জেলায় জেলায় সরকার’ একটি আকর গ্রন্থ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর এবং গণতান্ত্রিক জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রশাসনিক প্রতিবেদন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্ত্রী সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব আবুল মাল আবদুল মুহিত আত্মজীবনী লেখার কাজও প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে তার ছিল গভীর আশাবাদ। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এ নিয়ে তার ছিল গভীর আত্মতৃপ্তি।

আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথাগত রাজনীতির পথে না হেঁটে জাতির বিকাশমান ধারাকে অগ্রবর্তী করেছেন। ঐতিহ্যের পরম্পরা ধারণ করে দলীয় রাজনীতি করেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বদলীয় অভিভাবক। পরিশীলিত বুদ্ধিবৃত্তিক মন ও রুচিশীল সাদামনের মানুষ হিসেবে ছিলেন জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির সারথি।

লেখক : আবদুর রহিম হারমাছি – সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ