1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সরকারের উদ্যোগ: ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী করা নিয়ে কিছু কথা

নিরঞ্জন রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৩

সরকার সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে সরকার দেশের ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং মন্ত্রিসভা এই আইন সংশোধনের খসড়া অনুমোদনও দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব যে কত বেশি, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে সম্প্রতি আমেরিকা ও ইউরোপে ধসে পড়া ব্যাংকগুলো উদ্ধারে সরকারের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে, নিজস্ব চেষ্টায় টিকে থাকে এবং টিকতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে প্রতিদিন অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি অনেক বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায়ই বন্ধ হয়ে গেলেও এখানকার সরকার সেগুলো রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ সেভাবে নেয় না, যতটা নেয় কোনো ব্যাংককে রক্ষার জন্য। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত দুটি ঘটনা, চীন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন এবং মধ্যপ্রাচ্যের চিরশত্রু বলে খ্যাত ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের জোরালো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ তারা এখন তাদের দেশের ব্যাংকিং খাত ঠিক রাখতেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার যে দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখা এবং এর অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হলে মানসম্পন্ন এবং স্থিতিশীল ব্যাংকিং খাত নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। আশার কথা এই যে সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এখন সেই পথেই হাঁটছে।

দেশের ব্যাংকিং খাতের মানোন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রস্তাবিত ব্যাংক কম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধনীতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—১. পরিবার থেকে ব্যাংকের সর্বোচ্চ পরিচালকের সংখ্যা চারের পরিবর্তে তিন; ২. ব্যাংকের পরিচালকদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদান নিষিদ্ধ এবং ৩. ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের (উইলফুল ডিফলটার) শাস্তির বিধান। এ ছাড়া ব্যাংকিংসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন; যেমন—হস্তান্তরযোগ্য ঋণের দলিল আইন (নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট), দেউলিয়া আইন এবং অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। হস্তান্তরযোগ্য ঋণের দলিল আইন অনেক আগেই সংশোধন করা উচিত ছিল। কেননা এই আইন সেই ১৮৮১ সালে প্রণীত হয়েছে এবং এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাংকিং লেনদেনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেমন—চেক এখন আর একমাত্র ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যম নয় এবং অনেক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর লেনদেনের মাধ্যম ব্যাংকে ব্যবহৃত হচ্ছে। তা ছাড়া এই আইনে এমন কিছু ধারা আছে, যা কখনোই ব্যাংকিং লেনদেনে ব্যবহৃত হয় না। যেমন—নট নেগোশিয়েবল লেখা ক্রসড চেক দিয়ে কেউ কোনো লেনদেন করে না। এ কারণেই এই আইনটি আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন।

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা চার থেকে কমিয়ে তিন করার মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের দেশে ব্যাংক পরিচালনার দৈনন্দিন কাজে, বিশেষ করে ঋণ মঞ্জুরের মতো দায়িত্ব পালনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যেভাবে সরাসরি জড়িত, সেখানে পরিবারের পরিচালক সংখ্যা কমিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করা কষ্টকর। ১৯৮০-এর দশকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবার থেকে একজন পরিচালকই মনোনীত হতেন এবং তখনো পরিচালকদের ব্যাংকে ঋণদানে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ছিল। মূলত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যকার সীমারেখাটা সবার আগে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। পরিচালনা পর্ষদ শুধু ব্যাংক পরিচালনার নীতি প্রণয়ন, ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং সেই ঝুঁকি লাঘবের বিধি-বিধান প্রণয়ন করে তা ব্যাংকে শতভাগ প্রয়োগ করার দায়িত্ব পালন করবে। পক্ষান্তরে প্রধান নির্বাহীর নেতৃত্বে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট টিম বোর্ড কর্তৃক প্রণীত নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান এবং ঝুঁকি ও ঝুঁকির শর্তগুলো মেনে ব্যাংক পরিচালনা করবে। এসব শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে বা নিয়ম ভঙ্গের জন্য প্রধান নির্বাহীসহ ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্য যুগপৎ বোর্ড, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আদালতের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। একইভাবে যথাযথ বিধি প্রণয়ন, ঝুঁকি চিহ্নিত ও লাঘব করার উদ্যোগ নিতে ব্যর্থতার কারণে বোর্ড দায়ী থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আদালতের কাছে। বোর্ড প্রদত্ত নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান এবং রিস্ক প্যারামিটার নিশ্চিত করতে হবে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে, যাতে এর পরিপালন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয় এবং কেউ চাইলেও যেন কোনো ধরনের বিচ্যুতি ঘটাতে না পারে। ব্যাংক পরিচালনায় এই পদক্ষেপগুলো নিতে পারলেই ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ব্যাংক পরিচালকদের জামানতবিহীন ঋণদান বন্ধ করে কতটা ভালো ফল পাওয়া যাবে, তা বলা কষ্টকর। কেননা জামানত নিয়ে ঋণ প্রদান করে সেই ঋণ আদায়ের পরিসংখ্যান মোটেই সন্তোষজনক নয়। জামানত নিলেই যদি ঋণ সময়মতো ফিরে আসত, তাহলে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের অবস্থা এত খারাপ হতো না। আসলে জামানত নিয়ে ঋণদান পদ্ধতি ভুল প্রমাণিত হয়েছে অনেক আগেই। তাই এই বিষয়টিকে নতুন করে সামনে এনে অবস্থা আরো জটিল করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। তা ছাড়া ব্যবসায়ীরাই ব্যাংকের মালিক হবেন এবং তাঁদের যদি সফল ব্যবসা থাকে, তাহলে তাঁরা ঋণ পেতেই পারেন। তবে তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত কঠোর শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা থাকবে। এসব শর্তের পরিপালনও নিশ্চিত করতে হবে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে, যাতে কারো মুখের কথায় শর্তের ব্যত্যয় না ঘটে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি এক জটিল এবং দুর্বোধ্য বিষয়, যা যতটা আইনগত, তার চেয়ে বেশি প্রচলিত ধারণা। কারণ ব্যাংকিং পরিভাষায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংজ্ঞায়িত করা কঠিন এবং আইনের চোখে তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য কাজ। ফলে এই ধারা দিয়ে কোনো ঋণগ্রহীতাকে আদালতে আইনের দৃষ্টিতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া ব্যাংকের প্রচলিত বিধি-বিধান যদি প্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে এমনিতেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পাবে। আন্ত কম্পানি লেনদেন ব্যতীত যেসব ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত অর্থ স্থানান্তর বা পাচার করবেন, তাঁরা এমনিতেই ঋণচুক্তির শর্ত ভঙ্গের এবং সেই সঙ্গে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অমান্যের জন্য অপরাধী হবেন এবং তাঁদের সেই আইনের অধীনেই বিচার করা সম্ভব। আর যেসব ঋণগ্রহীতা অসত্য তথ্য এবং ভুয়া কাগজপত্র সরবরাহ করবেন, তাঁরা তো ক্রিমিনাল অপরাধ করবেন এবং তাঁদের সেভাবেই বিচার করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধনী ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ বন্ধ বা আদায়ে খুব বিশেষ ভূমিকা রাখবে কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে যে অব্যবস্থা বিরাজ করছে, তা দূর করে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে অর্থনীতির এই অত্যাবশ্যকীয় খাতের মান উন্নত করতে হলে সামগ্রিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. ব্যাংকিং কার্যক্রমকে সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তিনির্ভর করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রূপান্তর করা; ২. ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করা; ৩. যোগ্য ও পেশাদার ব্যাংকারদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়া এবং ৪. খেলাপি ঋণের সন্তোষজনক সুরাহা করা।

এসব পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে পারলে বাকি যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে চলেছে এবং আগামী দিনেও চলবে, তাকে টেকসই করতে হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের মান উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে আমরা যখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি, তখন দেশের ব্যাংকিং খাতকে আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি নিতেই হবে। সরকার হয়তো সেই কাজটাই শুরু করেছে মাত্র।

 লেখক: নিরঞ্জন রায় – সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ