1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

রোহিঙ্গাদের দায়ভার কি বাংলাদেশের একার?

দেলোয়ার হোসেন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২

রোহিঙ্গা সংকট কয়েক দশকের পুরোনো হলেও ২০১৭ সালে বিষয়টি যেদিকে মোড় নিয়েছে, তা প্রতিবেশী কিংবা আঞ্চলিক সংকট থেকে আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। ওই সময় নিজ দেশে রোহিঙ্গারা যেভাবে গণহত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়, তখন পাশে মানবতার আহ্বানে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, তখন থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল। অনেকেই রোহিঙ্গা তহবিলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছিল। সাম্প্রতিক ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক কোনো কোনো মহল থেকে আগের মতো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ইউক্রেন ও আফগানিস্তানের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা তহবিলে সংকট হতে পারে বলে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।

ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির রোহিঙ্গা তহবিল কমে যাওয়ার আশঙ্কার বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সংকট রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম ‘অ্যাক্টর’। সেদিক থেকে আমরা দেখছি, পশ্চিমারা যেভাবে ইউক্রেনকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দিক থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য যেভাবে এগিয়ে আসার কথা ছিল, সেটা আমরা দেখিনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোরালো সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি সে ধরনের জোরদার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো আমরা এ বিষয়টি নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজনও লক্ষ্য করেছি। চীন-রাশিয়া যেমন মিয়ানমার সরকারের পক্ষে; ভারত-থাইল্যান্ডও তেমনি ভূরাজনৈতিক দিক বিবেচনায় নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় এর বাইরে নয়। এত বছরের মধ্যে তাদের অবস্থানে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমারবিরোধী অবস্থান থাকলেও, তা চাপ সৃষ্টি করার মতো জোরালো নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি মুসলিম দেশ রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ না করায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর তেমন চাপ তৈরি হয়নি। বলা বাহুল্য, রোহিঙ্গা সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হলো তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার দায় দেশটির। দুঃখজনক হলেও সত্য, মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবেই প্রত্যাবাসন থমকে আছে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য হতাশার বিষয়। মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রশ্নে বিশ্বের নীরবতা লজ্জাজনক।

আমরা দেখেছি, ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব বারবার স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইনের কথা বলছে। সেখানে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে। মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা করেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এমনকি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা হিসেবে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই স্বীকৃতি দিয়েছে। এখানে স্বীকৃতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও তৎপরতা প্রয়োজন।

বলা চলে, রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ একাই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটও বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি কক্সবাজার ও ভাসানচরের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর যথার্থই বলেছেন, গত পাঁচ বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় জনগোষ্ঠী যে সংকট মোকাবিলা করছে, তা বিশ্বকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ও আশ্রিত মানুষের জীবন নির্ভর করে তাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আচরণের ওপর। তার ভাষায়, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ এবং কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা আমি তুলে ধরতে চাই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মনে করিয়ে দিতে চাই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত তাদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সহায়তার গুরুত্ব। ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। একটি তহবিল, অন্যটি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন।

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন হোক, তা আমরাও চাই। সেখানে সুষ্ঠু, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির দায়িত্বটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। প্রত্যাবাসনটা জরুরি আরও নানা কারণে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, অনেক রোহিঙ্গা নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, হত্যা এমনকি মানব পাচারের সঙ্গেও তারা জড়িত। সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি গ্রুপ মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অপরাধীদের জন্য নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবার মজুত ও লেনদেনের জন্য সেগুলো ব্যবহার করছে অপরাধীরা। সেখানে রোহিঙ্গা যে ঝুঁকি তৈরি করছে, তার প্রভাব কেবল বাংলাদেশেই পড়বে না; এমনকি গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

রোহিঙ্গারা যতদিন বাংলাদেশে থাকছে, তাদের ভরণ-পোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখতেই হবে। অথচ গত কয়েক বছর ধরেই তাদের জন্য আসা তহবিলের হার কমছেই। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাই নতুন করে তহবিল সংকটের বিষয়টি সামনে আনছে। এটা নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। দেশের একাধিক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক সহায়তার জন্য যৌথ রেসপন্স প্ল্যান বা জেআরপির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই এ তহবিল সংগ্রহের পরিমাণ কমছে। গত ৪ বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণ মানবিক সহায়তা তহবিল প্রয়োজন ছিল তার ৭০ শতাংশের বেশি পাওয়া যায়নি। এ তহবিলের জন্য ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে ১ হাজার ৫৮ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬২৯ মিলিয়ন ডলার। এ বছরের অবস্থা আরও খারাপ। চলতি বছর ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য মোট ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা চেয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৮৫ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সহায়তা পেয়েছে ৩৪ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার, যা প্রতিশ্রুতির ১২ শতাংশ।

এভাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা যত কমবে, বাংলাদেশের ওপর চাপও তত বাড়বে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যদি বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বিষয়টি কম গুরুত্ব দেয়, তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ঘটনা। ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য যেমন বিশ্ব এগিয়ে আসছে; রোহিঙ্গাদের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটি এখানে দিন দিন বেড়েই চলেছে। নতুন যে শিশু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে জন্ম নিচ্ছে, তার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরেই পড়ছে। এখানে বিশ্ব সম্প্রদায় নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। রোহিঙ্গা সংকটকে কোনোভাবে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই।

রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের জোরদার তৎপরতা দরকার। এ ধরনের মানবিক বিষয়ে নিজেদের শত্রুতা ভুলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষ এক জোট হলে মিয়ানমার নিঃসন্দেহে প্রত্যাবাসনে এগিয়ে আসতে বাধ্য হবে। আর প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত তহবিল নিশ্চিত করা চাই। এটা তাদের দান বা করুণা নয়, বরং দায়িত্ব।

লেখক : ড. দেলোয়ার হোসেন – অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ