1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী ঐক্যের

ড. প্রণব কুমার পান্ডে : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবিক চ্যালেঞ্জ। মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গোষ্ঠী বহু দিন ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন ও সহিংসতার মুখোমুখি হয়ে আসছে, যার ফলে তারা বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় চেয়েছে, যা দেশের সম্পদ এবং অবকাঠামোর ওপর একটি বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে। এই নিবন্ধটিতে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টাকে সহজতর করার জন্য পরাশক্তির ভূমিকার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রোহিঙ্গা সংকটটি আলোচনা করা হয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা মূলত কয়েক দশক ধরে পদ্ধতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়ে আসছে। চলাফেরার স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়ে নাগরিকত্ব এবং অপরিহার্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, যৌন সহিংসতা এবং অগ্নিসংযোগের মতো নৃশংসতা। ২০১৭ সালের আগস্টে সামরিক দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন বাংলাদেশের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। কক্সবাজারে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যেখানে যথাযথ স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুবিধার অভাব রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বিধায় সে সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট একটি মানবিক ও মানবাধিকার ইস্যু, যা রাজনীতি ও ক্ষমতার গতিশীলতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইস্যুটিকে ঘিরে অন্তর্নিহিত রাজনীতি সমাধান প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগে অবদান রেখেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত অবস্থান ও সম্পদের কারণে রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একটি প্রধান বৈশ্বিক শক্তি এবং মিয়ানমারের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু, ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা এবং কৌশলগত স্বার্থ চীনের প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে। অনেক সময় চীন মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক চাপ থেকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর ক্ষমতা প্রয়োগ করার মাধ্যমে মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপনসূচক রেজুলেশন পাস হতে বাধা প্রদান করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় চীনের কাছে এই সমস্যার সমাধানের চেয়ে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্র বারবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নৃশংসতার জন্য দায়ী মিয়ানমারের প্রধান সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উল্লেখযোগ্য মানবিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। তবে, মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার কার্যকারিতা সীমিত।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সক্রিয়ভাবে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা, মানবিক সহায়তা প্রদান এবং জবাবদিহির পক্ষে কথা বলছে। ইইউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার প্রমাণ নথিভুক্ত করার উদ্যোগকে সমর্থন করছে। যাহোক, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জটিল রাজনৈতিক গতিশীলতার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আঞ্চলিক শক্তি এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে ভারত রোহিঙ্গা সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদিও ভারত মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তবে ভারত তার নিরাপত্তা স্বার্থ এবং দেশীয় রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। ভারতের প্রতিক্রিয়া তাদের সীমান্তের মধ্যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পরিবর্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকটে রাশিয়ার সম্পৃক্ততা ন্যূনতম ছিল। তারা মূলত মিয়ানমারের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছে। রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে এবং মিয়ানমার সরকারকে অস্ত্র বিক্রিসহ সামরিক সহায়তা দিয়েছে। রাশিয়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ওপর জোর দিয়েছে বিধায় তাদের অবস্থান চীনের সঙ্গে মিলে যায়।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত প্রত্যাবাসনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এই বিষয়ে মিয়ানমার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নিশ্চয়তা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত বৈষম্যের মতো সংকটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করা একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে টেকসই সহায়তা প্রদান এবং শরণার্থীদের জীবনমানের উন্নয়ন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং প্রত্যাবাসন সহজতর করতে পরাশক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যদিকে, চীনের উচিত মিয়ানমারের ওপর তার চাপ বৃদ্ধি করা। এরমধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকারের নিশ্চয়তা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বৈষম্যের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার মতো নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া। চীনের অর্থনৈতিক সুবিধা মিয়ানমারের সম্মতি প্রদানকে উৎসাহিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা সহজতর করতে এবং একটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সংলাপ এগিয়ে নিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত আঞ্চলিক উদ্যোগকে সমর্থন করে এবং আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা)-এর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে তার সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি ব্যাপক ও সমন্বিত পদ্ধতির পক্ষে ওকালতি করা এবং প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা, মানবাধিকার এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া।

একটি টেকসই সমাধান খুঁজতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতের আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। প্রত্যাবাসনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে আসিয়ান এবং জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সংলাপ এবং সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ভারত তার কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে মিয়ানমারকে সংকটের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করতে পারে।

রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যা মানবাধিকার ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিভিন্ন মাত্রার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। যদিও কিছু দেশ ও সংস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারকে সহায়তা বন্ধ এবং নিন্দা করতে সক্রিয় হয়েছে, অন্যরা ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা বা অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করেছে। এটি বিভাজন তৈরি করেছে এবং সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টার কার্যকারিতা সীমিত করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের উচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়াতে এবং সমর্থন চাওয়ার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মতো বহুপাক্ষিক ফোরামে অংশগ্রহণ করে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সমমনা দেশ এবং সংস্থার সঙ্গে জোট গঠন মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে, একটি নিরাপদ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা অপরাধীদের জবাবদিহি করতে সহায়তা করবে। প্রমাণ নথিভুক্ত করার জন্য সহায়ক উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতের আইনি পদক্ষেপকে শক্তিশালী করবে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট একটি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যার জন্য প্রত্যাবাসন সহজতর করতে এবং সংকটের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার জন্য পরাশক্তিসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যদিও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক স্বার্থগুলো পরাশক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তবে তাদের অবশ্যই রোহিঙ্গা জনগণের মঙ্গল ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার মাধ্যমে, পরাশক্তিগুলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং বাংলাদেশকে তার মানবিক প্রচেষ্টায় সমর্থন করতে পারে। শুধু সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই সমাধান অর্জন করা যেতে পারে।

লেখক:  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক-প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ