বাঙালির সামাজিকতা ও খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবারের গুরুত্ব অনেক। বিয়ে, জন্ম, বা যেকোনো শুভ সংবাদে পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা বাঙালি সমাজের এক চিরকালীন প্রথা। সেই মিষ্টির তালিকায় রয়েছে রসগোল্লা, চমচম, রসমালাই, প্রাণহারা, সন্দেশ, ছানামুখী, মণ্ডা, মকড়ম, আমিট্টি বা আমৃতিসহ আরও অনেক নাম।
আবার এই মিষ্টির বিভিন্ন নামের সঙ্গে সম্পর্ক ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। চমচমের সঙ্গে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি, কাঁচাগোল্লার সঙ্গে নাটোর, রসমালাইয়ের সঙ্গে কুমিল্লা, রসগোল্লার সঙ্গে বিক্রমপুর ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বগুড়া ও বরিশালের গৌরনদীর দই, যশোরের খেজুরগুড়ের সন্দেশ, মণ্ডার সঙ্গে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, আমৃতির সঙ্গে খুলনা ও মুন্সিগঞ্জ, বালিশ মিষ্টির সঙ্গে কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা অঞ্চলের নাম জড়িত।
এসব অঞ্চলের ময়রাদের (যে মিষ্টি তৈরি করে) বিশেষ পারদর্শিতা, নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের এ মিষ্টির নামগুলো। এমন অনেক নামের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী হয়ে স্বাদের দিক দিয়ে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ‘প্যাঁড়া মিষ্টি’।
সরিষাবাড়ির উপজেলার মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্যাঁড়া মিষ্টি তারা বংশানুক্রমে তৈরি করে আসছেন। মূলত হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুধের ক্ষীর এবং আখের রসের মিশ্রণে এক ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি হতো। সেই হতে ধীরে ধীরে তা প্যাঁড়া মিষ্টিতে রূপান্তর হয়। অন্যান্য মিষ্টি তৈরির চেয়ে পরিশ্রম বেশি হলেও এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় সরিষাবাড়ীর প্রায় প্রত্যেকটি মিষ্টির দোকানেই এই প্যাঁড়া মিষ্টি তৈরি হয়।
সুস্বাদু এ প্যাঁড়া মিষ্টি প্রস্তুতকারক সরিষাবাড়ী উপজেলার শিমলাবাজারের কাঁলাচাদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী সুমন ঘোষের সঙ্গে আলাপকাল হয়। তিনি জানান, তার দোকানে বিভিন্ন রকমের মিষ্টির মধ্যে সবার আকর্ষণ থাকে এই প্যাঁড়া মিষ্টিতে। প্রতিদিন ৮০-১০০ কেজির মতো প্যাঁড়া মিষ্টি তৈরি করেন তিনি। নিজ উপজেলার মানুষের চাহিদার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ পাশের জেলাশহর ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইলসহ অনেক জায়গায় এই প্যাঁড়া মিষ্টি সরবরাহ করে থাকেন তিনি।
তিনি বলেন জানান, তার দোকানের এই প্যাঁড়া মিষ্টি দেশের বাইরেও সরবরাহ করা হয়। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি, মালোয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি-আরব, দুবাই প্রভৃতি দেশে থাকা এ অঞ্চলের প্রবাসীদের কাছে সরবরাহ হয়ে থাকেন এ প্যাঁড়া মিষ্টি। শুকনো পাত্রে দেড় থেকে দুই মাস সংগ্রহ করে খাওয়া যায় বিধায় বিদেশে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্যাঁড়া মিষ্টির কদর একটু বেশি। তাদের মাধ্যমে এসব দেশের স্থানীয় লোকদের কাছেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে এ প্যাঁড়া মিষ্টি।
এ কারিগর বলেন, দুধের ক্ষীর তৈরি করে তাতে চিনির মিশ্রণের একটা সঠিক অনুপাত প্রয়োজন হয়। আর এই অনুপাতের তারতম্য হলে এই মিষ্টির স্বাদ ও মান দুটোই নষ্ট হয়ে যায়।
আঞ্চলিক খাবারের প্রতি মানুষের টান সবসময় থাকে। আর মিষ্টি জাতীয় খাবার হলে তো কথাই নেই। আর তাই এ প্যাঁড়া মিষ্টির চাহিদা এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। ভবিষ্যতে এ চাহিদা আরও বাড়বে বলে আশা করছেন সরিষাবাড়ীর মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। আর এ জন্য তারা সরকারের পৃষ্টপোষকতা কামনা করছেন।