‘কুঁ ঝিক ঝিক’ ট্রেনের শব্দে ঘুম ভাঙবে সৈকতের মানুষের। সাগরতীরের কক্সবাজার শহরের দিকে যাত্রীবাহী ট্রেন ছুটে এসে থামবে বিশাল ঝিনুকাকৃতি রেলস্টেশনে। কক্সবাজারের ঝিলংঝার চান্দেরপাড়ায় অনন্য স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এশিয়ার বৃহৎ রেলস্টেশনটি এখন দৃশ্যমান। এটি শুধু বিশ্বমানের আইকনিক রেলস্টেশনই নয়, পরিপূর্ণ একটি কমপ্লেক্স।
কক্সবাজারের চান্দেরপাড়ায় নির্মিত দেশের প্রথম ছয়তলা বিশিষ্ট আইকনিক রেলস্টেশনে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। নান্দনিক ডিজাইনে গড়া স্টেশনটির নিচতলায় আছে টিকিট কাউন্টার, ৬টি লিফট ও ২টি চলন্ত সিঁড়ি, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয়তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিন তলায় তারকা মানের হোটেল। রয়েছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র। তাছাড়া এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, টুু্যরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবা কেন্দ্র।
ইতোমধ্যে রেললাইনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে স্টেশনটির নির্মাণ কাজ। ২৯ একর জমির ওপর ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুট জায়গায় গড়ে উঠছে রেলস্টেশন ছয়তলা ভবনটি। দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইন প্রকল্পে নির্মিত ৯টি স্টেশন হলো- কক্সবাজার, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী। এই রেলপথে নির্মাণ করা হয়েছে ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন ধরনের ৯৬টি লেভেল ক্রসিং। এছাড়া হাতি চলাচলের জন্য রাখা হয়েছে আন্ডারপাস।
কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বমানের অত্যাধুনিক এবং আইকনিক স্টেশন নির্মাণসহ চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ প্রায় ৯২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরই এই রেলপথ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য আগামী ১৫ অক্টোবর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুটে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ট্রেন চালাতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। পরীক্ষামূলক ট্রেনটি প্রস্তুত রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়া স্টেশনে। যেটিতে রয়েছে ৬টি বগি ও ২ হাজার ২শ’ সিরিজের একটি ইঞ্জিন। কোরিয়া থেকে আনা এসব বগির একেকটিতে ৬০ জন করে যাত্রী বসতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে দুই জোড়া ট্রেন চলবে। পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে যে-সব ট্রেন চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসে, সেসব ট্রেনের শেষ গন্তব্য কক্সবাজার হবে। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি ট্রেন চালু হবে।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, আগামী ডিসেম্বরেই পুরোদমে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে পূর্বাঞ্চলীয় রেল কর্তৃপক্ষের। কক্সবাজার রুটে ১৫-১৬টি বগি নিয়ে চলবে ট্রেন। ট্রেনগুলোতে পাওয়ার কার কোচ, কেবিন, এসি চেয়ার, এসি বার্থ, শোভন চেয়ার, গার্ডর্ যাক, বু্যফে কার সাজানো হচ্ছে। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দুটি প্রস্তাবনা রেল ভবনে পাঠানো হয়েছে। প্রথম প্রস্তাবনা, ঢাকা থেকে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে ভোর সাড়ে ৫টায় কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছবে। আবার ফিরতি পথে কক্সবাজার স্টেশন থেকে সকাল ১০টায় ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় ঢাকা থেকে রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে সকাল সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছাবে। ফিরতি পথে কক্সবাজার থেকে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে রাত ১০টায় ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আন্তঃনগর এসি চেয়ারের ভাড়া ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকার মতো, এখানে হয়তো ১২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে ভাড়ার ব্যাপারে শিগগিরই জানানো হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে মেগা প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এ মেগা প্রকল্পে ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আবদুল জাবের মিলন বলেন, ‘আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণের সময় চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং শ্রমিকসহ ছয় শতাধিক শ্রমিকের চার বছরের শ্রমে রেলস্টেশন ভবনটি এখন দৃশ্যমান।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘এটি কক্সবাজারবাসীর কাছে স্বপ্নের প্রকল্প। রেল চললে কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকা সবদিক দিয়ে ঘুরে যাবে। এতে পর্যটক যাতায়াত সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে-কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহণ করা যাবে।’
জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, ‘কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। রেললাইনটি পুরোপুরি চালু হলে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে পর্যটনশিল্পে। তবে অক্টোবরে পর্যটননগরী কক্সবাজারে সেই নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।’
কক্সবাজার-রামু আসনে সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল বলেন, ‘দোহাজারী-কক্সবাজার রেল চালু হলে কক্সবাজারের পর্যটনসহ অর্থনীতিতে বৈপস্নবিক পরিবর্তন আসবে। ২০১১ সালে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেলপথের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়েছে।’