1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন দ্বার উন্মোচন 

কর্নেল মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২

২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। আমাদের আর্থিক সক্ষমতা, পরিবেশবান্ধব পরিবহনব্যবস্থা ও টেকসই উন্নয়নের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে যাচ্ছে আধুনিক এ যোগাযোগ অবকাঠামো। ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা যানজট কমিয়ে নাগরিক জীবনকে গতিশীল করাই যার প্রধান উদ্দেশ্য। ২৫ জুন ২০২২ তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণের দুয়ার উন্মুক্ত করা পদ্মা সেতু যেমন ২১ জেলার সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে যোগাযোগব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছে, জীবনে এনেছে গতি, তেমনি আশা করা যাচ্ছে পদ্মা সেতুর মতোই ঢাকাকে নতুন এক অভিজ্ঞতার সুন্দর সকাল উপহার দেবে মেট্রোরেল।

মেট্রোরেল সার্ভিস বর্তমান সময়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে চলাচলের প্রধান বাহন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম চালু হয় ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল। পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময় জাগানিয়া বিখ্যাত সেই মেট্রোরেল আজও নিরবচ্ছিন্নভাবে লন্ডনবাসীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। চালু হওয়ার প্রথম দিনেই লন্ডনে ৩০ হাজার যাত্রী পরিবহন করে নাটকীয়ভাবে লন্ডনের মানুষের জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল মেট্রোরেল। গত ২০১৯ সালে লন্ডনে মেট্রোরেল ব্যবহার করেছেন ১.১৭ বিলিয়ন যাত্রী। ১১০ বছর আগের নিউ ইয়র্ক মেট্রো ২০২০ সালে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় ব্যবহার করেছে ১.৭১ বিলিয়ন যাত্রী। শুধু ইউরোপ আমেরিকায় নয় এশিয়ার জাপানে ১৯২৭ সালে চালু হওয়া মেট্রোরেল এখন সেখানকার প্রধান বাহন। মেগাসিটি টোকিওতে প্রতিদিন ৮.৭ মিলিয়ন লোক মেট্রোরেল ব্যবহার করে। বর্তমান বিশ্বের বড় শহরগুলোর মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে মেট্রোরেল।

রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। ঘনবসতির দিক থেকে ২০২২ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯,৩৫৩ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩০,৩৫৩ জন লোক বসবাস করে। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে ঢাকা পৃথিবীর জনবহুলতম শহর। যেখানে জীবনমান উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় অসহনীয় যানজট। আশা করা যায় এ যানজটের অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিতে পারবে কাক্সিক্ষত মেট্রোরেল।

২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোরেল প্রজেক্ট চালু করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ১২৮.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল এবং পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ করে ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে চায় সরকার। সব কটি লাইনের কাজ (সমীক্ষাসহ) চলমান থাকলেও বেশি অগ্রগতি হয়েছে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করা ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তরা থেকে মতিঝিল-কমলাপুর মেট্রোরেল প্রকল্প। এই মেগা প্রকল্পটি জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে উভয় দিকে থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ১৬টি স্টেশনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য ১৩.৪৭ মেগাওয়াট নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে, যার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ডেডিকেটেড বিদ্যুৎকেন্দ্র।

উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন। এ জনসংখ্যার বিপরীতে প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট বা যানবাহন খুবই অপ্রতুল। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় যানজটের কারণে ঢাকা নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ৩.২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অর্থমূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৭ সালে ঢাকা শহরে গাড়ির গড় গতি যেখানে ছিল ২১ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, সেখানে ২০১৭ সালে সে গতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ২০৩৫ সালে ঢাকার গাড়ির গড় গতি ৪ কিলোমিটার ঘণ্টায় নামতে পারে, যা হেঁটে চলা মানুষের গতির থেকেও কম। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গণপরিবহনের জন্য রাস্তা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তথ্য মতে, ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে ঢাকার সড়কের ৭৬.৩৫ শতাংশ আর ঢাকায় সড়ক আছে ভূমির ৭-৮ শতাংশ। রাজধানী ঢাকা আমাদের জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ জোগান দেয়, কেননা ঢাকাতেই সব বড় শিল্প-কারখানা ও অফিস। যানজট না থাকলে এ অবদান আরও অনেক বেশি হতে পারত। উত্তরা থেকে মতিঝিল যাতায়াত করতে যেখানে বর্তমানে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা, সেখানে মেট্রোরেল চালু হলে উত্তরা থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। যানজটে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না, মানসিক বিভিন্ন অবসাদের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি ঢাকাবাসী ভুগছে উচ্চ রক্তচাপ, বক্ষব্যাধিসহ আরও নানান স্বাস্থ্য সমস্যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে ২০৩০ সালে মেট্রোরেলের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে পরিবহনসেবা দেওয়া যাবে, যা ঢাকার যানজট এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অসামান্য অবদান রাখবে। সরকারের নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় মেট্রোরেলের সবগুলো রুট বাস্তবায়িত হলে তীব্র যানজটের শহর ঢাকা হয়ে উঠবে গতিশীল এক চঞ্চল নগরী। আমাদের গণপরিবহনে গর্ভবতী মহিলা, বয়স্ক মানুষ, নারী ও প্রতিবন্ধীরা অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার জন্য প্রধানত সমস্যায় পড়ে। মেট্রোরেলে এ বিশেষ মানুষগুলোর জন্য থাকছে বিশেষ সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতি নিয়ে মেট্রোরেল মাত্র ৩৮ মিনিটে যাত্রীদের পৌঁছে দেবে ঢাকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। মেট্রোরেলের উন্নতসেবার ফলে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে অনুৎসাহিত হবে, মেট্রোরেল হয়ে উঠবে প্রধান গণপরিবহন।

বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতালরেল ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ঢাকায় চালু হলে তা হবে ৫৭তম দেশ। কিন্তু অচিরেই ব্যবহারকরীর সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা উঠে আসবে প্রথম সারিতে। এখন যানজটের প্রতি মিনিটেই কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ তুলনামূলক কম আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ অসহনীয় যানজট। রিসার্চ গেটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ঢাকায় যানজটের কারণে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে এবং ২০১৮ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নিম্নমুখী প্রভাব ফেলছে।

মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অপারেটিং রুম, টিকিট কাউন্টার, ক্যাফেটেরিয়া, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাসহ পুরো সিস্টেম পরিচালনা করতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল বৃদ্ধি পাবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রায় ১২,০০০ জন প্রকৌশলীর কর্মসংস্থান হবে। আমাদের জনশক্তি নতুন এক প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত হবে। এতে আমাদের ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সাশ্রয় করবে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের মতে, মেট্রোরেল আমাদের প্রতি বছর ৩৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করবে। এ ধরনের বড় প্রজেক্ট চালানোর জন্য চাই দক্ষ কর্মিবাহিনী। তাই আমাদের দেশের লোককে কারিগরি বিষয়গুলোতে দক্ষ করে তুলতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম দিকে ৭৫ শতাংশ বিদেশি লোক কাজ করলেও বর্তমানে ৮০ শতাংশই বাংলাদেশি কাজ করছে।

মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালু। শুধু বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতি বছর দেশে কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল আমাদের পরিবেশকে খুব কম দূষিত করবে। রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করতে যথাযথ, সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অন্যতম পদক্ষেপ মেট্রোরেল ব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক যাত্রী পরিবহনে সক্ষমতার জন্য মেট্রো হয়ে উঠবে ঢাকার প্রধান বাহন। ফলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা হ্রাস পাবে, যা পরিবেশের জন্য উপকার হবে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ধারাবাহিকভাবে ছয়টি রুটে ১২৮.৭ কিলোমিটারে (৬১ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ডসহ) ১০৪টি স্টেশন নির্মাণের যে বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার তাতে ঢাকা অনেকটাই যানজটমুক্ত হবে। মেট্রোরেল প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ ৬০,০০০ যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম হলেও ঢাকায় স্কুল, কলেজ ও অফিস চলাকালীন যাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকবে। মেট্রোরেলের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তা দিয়ে বৃহৎ এ প্রকল্পে লাভ করার চিন্তা সরকারের আপাতত নেই। তার পরও নির্ধারিত ভাড়া শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ ও ভাসমান শ্রমিক, নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হচ্ছে কি না তা বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিনের অপরিকল্পিত ঢাকায় মেট্রো নির্মাণের পরও ফল পাওয়া চ্যালেঞ্জিং। যাত্রীদের মেট্রোরেল থেকে নেমে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী স্থানে যেতে সাপোর্টিভ পরিবহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। তা ছাড়া সংযোগ রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব চলাচল উপযোগী এবং হকারমুক্ত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।

২০৪১ সাল নাগাদ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষি, শিল্প, সেবা খাতে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বাংলাদেশ। আর এসবের কেন্দ্রবিন্দু তিলোত্তমা মহানগরী ঢাকা, যার জন্য টেকসই, পরিবেশ ও যাত্রীবান্ধব এবং সময় সাশ্রয়ী গণপরিবহনব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : কর্নেল মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী, বিএসপি – সামরিক বাহিনীতে কর্মরত


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ