1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে জিয়ার বিচার করতে হবে

ফারাজী আজমল হোসেন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২

সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার রায় কার্যকর শুরু হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। ওইদিন মধ্যরাতে ১২ আসামীর ৫ জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হরা হয়। তারা হলেন- সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদ। এরপর দীর্ঘ দুই যুগ ভারতে পালিয়ে থাকা খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ২০২০ সালের ৫ মে। এখনও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি পালিয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় ও এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অন্য তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হয় তারা পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আরেক আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। সরকার খুনী নূর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরিকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও আশ্রয়দাতা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তাতে সাড়া দিচ্ছে না।

তবে বিষয়টি এখানেই থেমে নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের মরণোত্তর বিচারের দাবিও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রমাণিত প্রধান দুই কারিগর হচ্ছেন- খোন্দকার মোস্তাক ও জেনারেল জিয়াউর রহমান। তারা দুজনই স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে খোন্দকার মোস্তাকের নাম এলেও জিয়াউর রহামনের নাম অজ্ঞাত কারণে স্থান পায়নি। খোন্দকার মোস্তাক মৃত উল্লেখ করে চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়। তবে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্বেও জিয়াউর রহমানের নাম কেন অভিযোগপত্রে রাখা হয়নি তা রহস্যাবৃত। ধারণা করা হয়, ওই সময়ের বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ আসতে পারে ভেবে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম এড়িয়ে যাওয়া হয়। এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে নামটি আবার সামনে আসে। মূলত জিয়া ছিলেন খুনিদের অনুপ্রেরণাদাতা এবং জিয়ার পিছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই বাংলাদেশের জনমের শত্রু। উভয় দেশই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানীদের সবরকম সহযোগিতা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়া রহমান জড়িত থাকার কথা প্রথম প্রকাশ করেন আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান। পঁচাত্তর পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে একাধিক গণমাধ্যমের সংগে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার নেপথ্য ভূমিকার কথা তিনি প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা করার পর খুনিচক্র সেনাবাহিনীর তখনকার উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংগে সাক্ষাত করে। তাদের পরিকল্পনার কথা শুনে জিয়া বলেন, ‘আমি এর মধ্যে নেই, তবে তোমরা যদি সফল হও তাহলে আমাকে পাবে। সেক্ষেত্রে শফিউল্লাহকে সরিয়ে আমাকে সেনা প্রধান করতে হবে’। জিয়ার এ কথায় খুনিরা উজ্জীবিত হয়। হত্যাপরবর্তী ঘটনায়ও জিয়ার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে। জেনারেল শফিউল্লাহ তার স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েই তিনি সব সিনিয়র অফিসারকে তার দফতরে ডাকেন। সেই ভোরে সবাই যে যে অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায়ই ছুটে আসেন। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল জেনারেল জিয়া। তিনি পরিপাটি হয়ে ও সেনাবাহিনীর পোশাক পরে এসেছিলেন। এতে ধারণা করা যায় ১৫ আগস্ট রাতের সব খবরই তার কাছ ছিল। সেনাবাহিনীর নতুন প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েই তিনি এসেছিলেন। খুনিরা জিয়াকে দেয়া কথার মর্যাদা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া নতুন সেনাপ্রধান হন এবং জেনারেল শফিউল্লাহকে মালোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জিয়াকে নিয়ে সন্দেহ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় তিনি এক ধরনের সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। এরপর ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ায় মেজর জিয়া হয়ে পড়েন জেষ্ঠ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা জিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। কারণ জিয়া আওয়ামী লীগবিরোধী লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। একদল ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপরদল ছিলেন ভাসানি ও চীন সমর্থক। জিয়া ছিলেন শেষোক্ত দলটিতে। মুক্তিযুদ্ধে চীন বাঙালির স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। কাজেই চীনের বন্ধু জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেলে মহান মুক্তিযুদ্ধ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশংকা করা হয়। এই অবস্থায় জেনারেল আতাউল গণি ওসমানিকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। তিনি অনেক আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপরই মুক্তিযুদ্ধ থেকে একপ্রকার হাত গুটিয়ে নেন তদনানিন্তন মেজর জিয়া। পরবর্তী সময়ে তাকে আর কোন অভিযানে অংশ নিতে দেখা যায়নি। তিনি আগরতলায় তার জন্য বরাদ্দ কুঠরিতে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন। জিয়াকে প্রথমে সেক্টর কমান্ডার এবং পরবর্তীতে জেড ফোর্সের অধিনায়ক করা হয়। নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাকে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়। কিন্তু তিনি তা পালনে অস্বীকৃতি জানান। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহেণের প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ায় তিনি রক্ষা পান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও সেনা প্রধানের দৌড়ে জিয়ার নাম চলে আসে এবং তিনি তৎপর হন। কিন্তু জিয়ার নিজ বাহিনীর ভিতর থেকে জোরালো আপত্তি আসায় দ্বিতীয় জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা মেজর শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান করা হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জুনিয়র কেউ সেনাপ্রধান হলে সিনিয়ররা অবসরে যান। কিন্তু জিয়া অবসের যেতে রাজি ছিলেন না। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দয়াপরবশ হয়ে সেনাবাহিনীতে উপপ্রধানের পদ সৃষ্টি করে জিয়াকে ওই পদে বসান। জিয়া খুশি মনে ওই পদ গ্রহণ করেছিলেন, এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং সেনাপ্রধানের পদলাভের জন্য তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। জুনিয়র কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাকে সে সুযোগ করে দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জিয়া প্রথমে সেনাপ্রধান ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে শুধু দেশের সর্বনাশ করেননি বরং দেশের মর্যাদাকর প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে যান। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে তাকে অপসারেণের জন্য ঢাকা সেনানিবাসে কমপক্ষে ১৮বার অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থান চেষ্টার দায়ে শত শত অফিসার ও জওয়ানকে ফাঁসি দেন জিয়া। এদের প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। অপরদিকে যাদের বিচারক বানিয়ে তথাকাথিত অভ্যুত্থানকারিদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয় তারা সবাই ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত বা অমুক্তিযোদ্ধা। অপরদিকে জিয়ার ক্ষমতায় আরোহণে যেমন দেশের মানুষ খুশি ছিলেন না, তেমনি বিদেশ বিশেষ করে ভারত সরকার তাকে সন্দেহের চোখে দেখত। ফলে দেশ পরিচালনায় নেমে তিনি ক্রমেই নিজে ডুবতে ও গোটা দেশকে ডুবাতে থাকেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অপরাধীদের আড়াল করার পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করে জিয়াউর রহমান বুঝিয়ে দেন তিনিই আসল কারিগর। একদল জুনিয়র সেনা অফিসার দিয়ে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং ব্যক্তিগত কর্মীদের হত্যা করা হলেও শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানি থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। জুনিয়র অফিসারেদের সামরিক অভ্যুত্থানটিতে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর নেতাও। আর তদের মধ্যমণি ছিলেন বঙ্গবন্ধুরই এক সময়কার সহকর্মী এবং আস্থাভাজন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরবর্তীতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন মোশতাক। তবে তার সেই ক্ষমতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল ষড়যন্ত্রী জিয়া পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোস্তাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।

১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা সহজ হলেও ক্ষমতা ধরে রাখা খুব কঠিন ছিল। তাছাড়া সামরিক ক্ষমতাধারীদের হাত ধরে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব বলে বারবার প্রমাণিত। বাস্তবে সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ গভীর সঙ্কটে পড়ে। চারিদিকেই শুরু হয় অস্থিরতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা দেশটি উন্নয়নের যাত্রা শুরু করলেও ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং ৪ লক্ষ বীরাঙ্গনার সম্ভ্রমনের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতাই গভীর সঙ্কটে পড়ে তার হত্যাকাণ্ডের কারণে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ফের ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। মাত্র ৪ দিনের মাথায় এই অভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতা জেনারেল খালেদ মোশাররফসহ তার সহযোগিরা শহিদ হন। ওই অভ্যুত্থানকে অনেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষের অভ্যুত্থান বলে মনে করেন। বাস্তবে এটা ছিল ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীন লড়াই। এ ধরনের পাল্টা অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহ দেশকে পঙ্গু করে দেয়। দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক শাসকের হত্যার পর বাংলাদেশ ১৫ বছর ধরে সামরিক অভ্যুত্থানের অধীনে ছিল। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিণত করতে। পাকিস্তানপন্থী অভুত্থানকারিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকেই ধংস করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু তিনি মাত্র আড়াই মাস ক্ষমতায় ছিলেন। পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সামরিক আইন ঘোষণা করেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধারণ না করেই দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম কয়েক মাস জিয়া সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়া বিচারপতি সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে এক অধ্যাদেশ জারি করেন। এই অধ্যাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

কিছুদিন বিরতির পর আবারও সামরিক শাসনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনকে দূরে রাখার চেষ্টা শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি সামরিক শাসক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে দেওয়ার জন্য তাদের স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে সংবিধান নিয়ে আসে। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদে থেকে একজন অনির্বাচিত মেজর জেনারেল কীভাবে সামরিক আইন প্রণয়ন করেছেন এবং সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধ সংশোধন করেছেন তা বিস্ময়কর। জিয়ার সামরিক শাসনামলে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা ও বিশ্বাস বাক্যাংশ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ পুনরুজ্জীবিত হতে দেখা গিয়েছিল ওই সময়ে। জামায়াত ও নিজাম- ই-ইসলাম একত্রিত হয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) গঠন করে। জামায়াতের নেতৃত্বদানকারী মাওলানা আবদুর রহিম আমির নির্বাচিত হন। জামায়াতের গোলাম আজমও ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

১৯৭৮-এ জিয়াউর রহমানের চেষ্টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং ১৯৮৬-র পরবর্তীতে জিয়ার সামরিক উত্তরসূরি হুসেইন মহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি গঠিত হয়। উভয় সামরিক শাসকই আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকারের মতো গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধকে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থেকে মুক্ত রাখে। এছাড়াও ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে সংবিধান আকস্মিকভাবে সংশোধন করে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাঠামোকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়।

জিয়ার শাসনামলে প্রধান রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে হাঁ, না ভোট অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন সামরিক তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ অবাধ ছিল না। ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন সামরিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সামরিক প্রশাসক জিয়াউর রহমানের বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় এবং আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৯টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়। জিয়ার উত্তরসূরি এরশাদের নেতৃত্বে জাপা, আওয়ামী লীগ, জামায়াত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। স্বৈরাচারী সামরিক নজরদারির অধীনে নির্বাচন জেপিকে সর্বাধিক আসন পাইয়ে দেয়। চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি (আ.লীগ, বিএনপি, জামায়াত) অংশগ্রহণ করেনি এবং এরশাদের জেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক পরিবর্তন, রাজনৈতিক আধুনিকায়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামরিক শাসন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও রুগ্ন করে তুলেছে। বেসামরিকীকরণ সত্ত্বেও সামরিক শাসন দেশে স্থায়ী গণতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ১৯৯০ সাল থেকে ব্যাপক রাজনৈতিক উত্থান আবারও প্রমাণ করে বেসামরিক বা সামরিক কর্তৃত্ববাদের বাংলাদেশের সমাজে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সব ধরনের সামরিক শাসন দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত হতাশাজনক। সামগ্রিকভাবে, সামরিক আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসকরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিকৃতি, অর্থনৈতিক সমস্যা, গার্হস্থ্য সহিংসতা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং গুরুতর সামাজিক অসমতাসহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। তাই বাংলাদেশের মানুষ সামরিক শাসনের জন্য আজও বঙ্গবন্ধুর আসল হত্যাকারী এবং দেশে সামরিক শাসনের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াকে ক্ষমা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ইচ্ছা অবশ্য জিয়ার সফল হয়নি।

দীর্ঘদিনের অরাজকতা শেষে বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশনেত্রী শেখ হেসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেশকে উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য সেটাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশ আজ আর তথাকথিত ‘বটমলেস বাস্কেট’ নয়। ইতিমধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পর জাপানের সহযোগিতায় রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু করেছে। তাই বলা যায়, জিয়া বা এরশাদের মত স্বৈরশাসকরা দেশকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে বটে কিন্তু অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে পারেনি।

লেখক : ফারাজী আজমল হোসেন – সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ