1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

জনকের প্রত্যাবর্তন

অধ্যাপক ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৩

ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি- ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন। প্রায় সাড়ে নয় মাস বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন ১০ জানুয়ারি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় বরণ করলেও স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত হয়। তাই সেদিন জনতার আবেগের ঢলে ভাসছিল রাজধানী ঢাকা, সমগ্র বাংলাদেশ। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুও আবেগের কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। লাখো জনতা আর বঙ্গবন্ধুর সম্মিলিত অশ্রুধারায় সেদিন আরো যেন উত্তাল হয়ে উঠেছিল রেসকোর্সের ময়দান, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের এই স্থানটি স্বাধীন দেশের মানুষের সম্মিলিত আবেগের অশ্রুতে ভেসে গিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শুরু করেছিলেন ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু, মুসলমান সকলের আত্মার মঙ্গল কামনার মাধ্যমে। অশ্রু সজলকণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসির কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বৃহস্পতিবার, বিকেল ৪.৩১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর ৯১,৪৯৮ সৈন্যসহ লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজির মুক্তিবাহিনীর এ.কে. খন্দকার, মেজর এ.টি.এম. হায়দার আর মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ লে. জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয়মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান এবং পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঠিক একই জায়গায় বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিরিশ লাখ শহিদের রক্ত আর আড়াই লাখের বেশি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশ, তবু দেশের মাটিতে নেই স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিব। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বঙ্গবন্ধুহীন এই বিজয় এই স্বাধীনতার উদযাপন কী করে পূর্ণাঙ্গ হয়! যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশ, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু। চারদিকে নানা জল্পনা কল্পনা। সব জল্পনা-কল্পনা ছাপিয়ে সকলের চিন্তা তখন একই লক্ষ্যাভিমুখী। আর তা হলো কবে আসবেন জাতির পিতা! পাকিস্তানিরা তাঁকে আদৌ ছাড়বে তো! মূলত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোর থেকেই বঙ্গবন্ধুর জন্য বাঙালির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হলেও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্য শুরু হয় বাঙালির অপেক্ষার প্রহর। একদিকে বাঙালির হৃদয়-আবেগের দোলাচল আর অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে চলে নানা ধরনের নাটকীয়তা! পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধুর জীবনও কাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। স্বদেশে না ফেরা পর্যন্ত, পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম না- করা পর্যন্ত বাঙালির যেমন স্বস্তি ছিল না তেমনি স্বস্তি ছিল না বঙ্গবন্ধুর নিজেরও।

এই অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাসের অবসান ঘটে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। নানা নাটকীয়তার পর মুক্ত বঙ্গবন্ধু এদিন স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। সহস্র বাঙালির আনন্দ, বেদনা ও ভালোবাসার স্রোতে বিলীন হন। কিন্তু তাঁর এই আগমনের পেছনে কত কথা, কল্পনা, কত কঠোর বাস্তবতা ছিল তার কতটা আমরা জানি! ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে বোয়িং ৭০৭ বিমানে সকাল সাড়ে ছটায় লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। ভুট্টো তাঁদেরকে বিমান পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের অতিথি হিসেবে লন্ডনে সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধি, দায়িত্বরত এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মত বিনিময় করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ এবং তাঁর লন্ডনে অবস্থানের খবর বিবিসি রেডিওতে প্রচার হওয়ার পর হোটেল ক্ল্যারিজে’স-এর সামনে শতশত মানুষ জমায়েত হতে থাকে। সেখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একজন বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহের শেষে আমাদের উপমহাদেশেই বসবাস করতে হবে। কাজেই পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সহযোগিতার ভাব রেখে আমাদের চলতে হবে, চলা উচিৎ’। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে কোন আপোষ হতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে দর কষাকষির প্রশ্নই ওঠে না। আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পাকিস্তান আমার কাছে অন্য যে কোনো একটি দেশের মতো। ২৫ মার্চ পাকিস্তান একটি জাতি হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছে এবং আমার জনগণ বীরের মত যুদ্ধ করেছে। তারা তাদের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছে। আমি কখনো তাদের অসম্মান করবো না, এমনকি আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি এই প্রতিশ্রুতি পালন করবো।’

ব্রিটিশ সরকারের রাজকীয় কমেট বিমানে ৯ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন বঙ্গবন্ধু। সাইপ্রাসে যাত্রা বিরতির সময় সেখানকার রাষ্ট্রপতি ম্যাকারিয়াস বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। তারপর ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্য ও কূটনীতিবিদেরা। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আবেগদীপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতরণ করেন বিকেল তিনটায়। একত্রিশবার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বংলাদেশ বরণ করে নেয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর তেজগাঁও বিমান বন্দর আর ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশ। প্রিয় নেতার প্রতি ভালোবাসার স্রোত সেদিন সকল প্রোটোকলও ভেঙ্গে গিয়েছিল। আবেগে ভেসেছেন বঙ্গবন্ধু, আবেগে ভেসেছে সমগ্র জাতি। তেজগাঁও থেকে রেসকোর্স ময়দান লাখো মানুষের ভালোবাসায় উপচেপড়া ভিড় পার হতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন ঘণ্টা! সেখানে তিনি ভাষণ দেন। অশ্রুসিক্ত বাঙালির মতো তিনি ভাষণ দেন আর কাঁদেন। কাঁদেন এদেশের ত্যাগী মানুষের জন্য।

তিনি বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ এরকম কত কথা! দীর্ঘ নয়মাস তাঁর বীর সন্তানদের গৌরবগাথা আর সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ারর প্রত্যয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোর রাতেই বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী। তারপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে কারাগারের ভেতরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, বাংলাদেশকে নিয়ে চলে নানা রাজনৈতিক কূটচাল। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বিচ্ছন্নতাবাদী প্রমাণের জন্য ঢাকা থেকেও পাকিস্তানিদের অনুগত ও তাবেদারদের স্বাক্ষী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট ইয়াহিয়া খান টেলিভিশন ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘শেখ মুজিবের বিচার করা হবে এবং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের আইন অনুসারে তাঁর বিচারের ব্যবস্থা করা হবে […] কৃতকর্মের সাজা তো তাঁকে পেতে হবেই।’ অবশ্য এর একদিন আগে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তর থেকে প্রচারিত এক প্রেসনোটে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে।’

এই ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী যেমন তোলপাড় শুরু হয় তেমনি তোলপাড় শুরু হয় প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। সর্বক্ষণ এক অজানা আশংকা বাঙালিকে দগ্ধ করেছে। কিন্তু সেখানে স্বস্তির কথা এই যে, পাকিস্তানের প্রহসনের এই বিচারের কথা শোনে সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং পাকিস্তানকে হুশিয়ার করে দেন এই বলে যে, ‘মুজিবের কোর্ট মার্শাল করা হলে এর পরিণতি হবে গুরুতর।’ পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও দ্রুত চব্বিশটি দেশের কাছে আবেদন জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার্থে কিছু করার জন্য। উদ্বেগ প্রকাশ করে আমেরিকাও পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শেখ মুজিবের গোপন বিচারের ‘সংক্ষিপ্ত আয়োজন’ পূর্ববঙ্গের সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানে সব সম্ভাবনা তিরোহিত করবে। অপরদিকে, জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পাকিস্তানের এরূপ বিচার প্রক্রিয়া এবং এই বিচারের ফলে বিশ্বব্যাপী সম্ভাব্য প্রভাবের আশংকা প্রকাশ ও পাকিস্তানি নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। নানা রকমের নাটকীয়তা শেষে সামরিক আদালত বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি এরূপ অমানবিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে বিশ্ববিবেক চুপ থাকতে পারেনি। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি হঠকারি সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয় এমনকি এক পর্যায়ে পাকিস্তানেরই আরেক নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোও এ রায় কার্যকরে বিরত থাকার জন্য ইয়াহিয়াকে অনুরোধ করেন। হাজার বছরের শেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাহস হয়নি। বরং সমগ্র বিশ্ব তোলপাড় হয়েছিল একচোখা পাকিস্তানি শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর জঘন্য প্রতিশোধ পরায়ণতায়। পাকিস্তারে কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিচার চললেও তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা ও অবিচল। তাঁকে যখন জেরা করা হতো সবসময়ই তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটাতেন। ঘটবেনই বা না কেন? তিনিইতো পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তাই আদালতের কার্যক্রমকে তিনি উপেক্ষা করে চলতেন সর্বদাই। এরকমই একটি ঘটনা- সপ্তম দিনের বিচারকার্য আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলে উকিল এগিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি কি নিজের পক্ষে কোনো অবস্থানই নেবেন না?’ এ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু আরো দৃঢ়তার সাথে অনুচ্চ স্বরে কেবল উচ্চারণ করেছিলেন- ‘না’। উকিল বলেছিলেন ‘আমার কাজ জটিল করে তুলছেন আপনি।’ তার জবাবে বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন : ‘তা জানি। তবে আমি কি করতে পারি? আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনো অধিকার এদের নেই। আইনের দিক দিয়ে কোনো বৈধতা এই আদালতের নেই।’

এছাড়া, আরেকটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করা যায়। ২৬ ডিসেম্বর আর্মি হেলিকপ্টারে এসে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির বাইরে এক বাংলোয় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত কমান্ডোবেষ্টিত অবস্থায় থাকতে হয়। ২৭ ডিসেম্বর ভুট্টো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি এখানে কী করে এলেন তা বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলে ভুট্টো জানান, তিনিই তখন পাকিস্তানের পরিবর্তিত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আগে বলুন আমি মুক্ত না বন্দি, তারপর আমি আপনার সঙ্গে কথা বলবো… অন্যথায় নয়।’ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের নিশ্চয়তা চাইলে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমার জনগণের সঙ্গে কথা না বলে আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারবো না। আগে আমি ফিরে যাই। তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলবো।’

আমরা দেখেছি যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর অবিচলতা আর স্থির মনোভাব। যা তাঁর নেতৃত্বগুণের অনন্য মহিমা। ১০ জানুয়ারি লাখো মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জনগণ এখন গৃহহীন, ভিখারি। বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য আমি বিশ্বের সকল দেশের কাছে সাহায্য কামনা করি।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমার বাংলা হলো সেই বাংলা যেখানে মানুষ খাবে-দাবে, হাসবে, গান গাইবে আর সুখে থাকবে। বাংলার সকলেই বাঙালি এবং আমরা সকলেই একসঙ্গে বাস করবো।’ বন্দিদশার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলন, ‘বারবার যে প্রশ্নটি আমার মনে জেগেছে- আমার সোনার বাংলায় আমি কি আদৌ কোনোদিন যেতে পারবো? ওরা আমার কবর খুঁড়ে রেখেছে। একমাত্র মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে আজ আমি এখানে।’

বাংলাদেশের অসহায় ও নিরন্ন মানুষের মুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব মানবতারও ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্ব বাঙালিকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছে। অসহায় ও নিরন্ন মানুষের মৌলিক দাবি পূরণের লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো কোনো নেতা নিজেকে উৎসর্গ করেননি। অথচ এদেশের মানুষের মন থেকে জাতির জনককে ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছিল স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। ইতিহাস থেকে তাঁকে মুছে ফেলা, কিংবা নানা অপকৌশলে তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকারীদের মুখই বরং ম্লান হয়ে গেছে! দিনদিন বঙ্গবন্ধু আরও ভাস্বর হয়ে উঠছেন। বিশ্বমানবের মহান নেতার আসনে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বিশ্বব্যাপ্ত অসহায় মানুষের পরিত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বগুণেই প্রমাণ করেছেন তিনিই বাঙালির আদর্শ নায়ক।

লেখক : ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম – অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ