বাংলাদেশে ধানের পরেই গম দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এ দেশে গমের আবাদ ছিল না বললেই চলে এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে দেশে গমের আবাদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে খাদ্য হিসেবে গমের বহুবিধ ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর গমের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন, যা মেটাতে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। বর্তমান বৈশ্বিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ৩০০ কোটি ইউএস ডলার বা তারও বেশি। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার গমসহ আমদানিনির্ভর ফসলের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে আট লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টন গম উৎপাদিত হলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ফসলের (আলু, ভুট্টা, উচ্চমূল্যের সবজি, বোরো ধান ইত্যাদি) সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলে গমের আবাদ ও উৎপাদন দুটিই ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বর্তমানে প্রায় ৩.৩০ লাখ হেক্টর জমিতে গম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ টন, যা চাহিদার মাত্র ১৭ শতাংশ।
গম চাষের অতীত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে ভবিষ্যতে গম উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। প্রচলিত এলাকায় গমের উন্নত জাত এবং আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের মাধ্যমে গমের ফলন বৃদ্ধি এবং অপ্রচলিত এলাকায় গমের আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন।
গমের আধুনিক জাতগুলো অপেক্ষাকৃত স্বল্পমেয়াদি এবং তাপসহিষ্ণু হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি দেশের অপ্রচলিত অঞ্চল, যেমন—দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিভিন্ন নদীর চরাঞ্চল, সিলেট অঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ের উপত্যকা ইত্যাদি এলাকায় সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ আছে। কারণ এসব এলাকায় ফসলের নিবিড়তা কম এবং এখনো রবি মৌসুমে অনেক জমি পতিত থাকে। তা ছাড়া রাজশাহী জেলার খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে হালকা সেচে গম আবাদ সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ আছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় চার লাখ হেক্টর জমি রবি মৌসুমে পতিত থাকে, যা গম চাষের উপযোগী। এসব অপ্রচলিত এলাকায় গমের নতুন জাত এবং উৎপাদন প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অতিরিক্ত গম খাদ্যভাণ্ডারে যুক্ত হবে। এ জন্য প্রয়োজন গম চাষ ও বীজ উৎপাদনের ওপর বেশি বেশি প্রদর্শনী স্থাপন ও কৃষক প্রশিক্ষণ এবং এসব এলাকার কৃষকদের গম চাষে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ সরকারি প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ।
গমের ফলন বৃদ্ধিতে গুণগত ও মানসম্পন্ন বীজের বিকল্প নেই। শুধু ভালো বীজ ব্যবহার করে গমের ফলন ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাই সারা দেশে মানসম্পন্ন বীজের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও চাষি পর্যায়ে চলমান উন্নত জাতের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। তা ছাড়া কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী গম বীজ বপন ও মাড়াই যন্ত্রের সরবরাহ এবং ব্যবহার বাড়াতে হবে। গমের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারা দেশে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তা আরো বাস্তবমুখী করে জোরদার করা প্রয়োজন। গমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে সরকারি পর্যায়ে অঞ্চলভিত্তিক গম উৎপাদন নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতিতে এবং বাস্তবতার নিরিখে আগামী পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে গমের বর্তমান উৎপাদন দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও তা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।