1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্ত ও আমাদের প্রেক্ষাপট

ড. মো. আনিসুজ্জামান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩

শাসনব্যবস্থার মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রাচীন। গ্রিসের নগররাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হতো ভারতবর্ষের গণরাজ্যগুলো। এথেন্সের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি ছিল দাস। দাস এবং নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোতে দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। নারীর ন্যূনতম মর্যাদা নগররাষ্ট্রে ছিল না। এথেন্সের চার লাখ অধিবাসীর মধ্যে আড়াই লাখ ছিল দাস। মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি।

গ্রিসে নগররাষ্ট্র বিকাশের কয়েক শ বছর আগে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ভারতবর্ষে অনেক ছোট ছোট রাষ্ট্র ছিল। বৈশালি, মগধ শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ভদ্রবাহুর কল্পসূত্র গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, আর্যাবর্তের পূর্বপ্রান্তবাসী ক্ষত্রিয় শাক্য ও লিচ্ছবিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ঘন ঘন বিদ্বৎসভার অনুষ্ঠান হতো এবং সেই সব সভা, সমিতি ও পরিষদে বক্তৃতা ও বিচার করার অধিকার নর-নারী-নির্বিশেষে সবারই ছিল। শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রতিফলন দেখা যায়। ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সময় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে চলছে ভাইকিংদের দৌরাত্ম্য। সভ্যতার ‘স’-ও তাদের ছিল না।

ভারতবর্ষের রাষ্ট্রগুলো মিলে শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সাম্রাজ্যে কোনো একক রাজা ছিল না। রাজার কথাই আইন, প্রাচীন ভারতবর্ষে গুরুত্ব পায়নি। মগধের রাজা অজাতশত্রু রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। ত্রিপিটকের অঙ্গুলিমাল সূত্রে দেখা যায়, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে কোশলরাজ প্রসেনজিৎ ডাকাত অঙ্গুলিমালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আগে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পরামর্শের উদ্দেশ্যে। ওই সময় চেটকের সাম্রাজ্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। ৯ জন মল্লি ও ৯ জন লিচ্ছবি ‘গণ রাজা’  (Confederate Princess) নিয়ে ছিল বৈশালিপতি চেটকের সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যসংক্রান্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চেটক পূর্বোক্ত অষ্টাদশ গণরাজাকে নিয়ে পরামর্শ করতেন এবং সবার মতামত গুরুত্ব দিতেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বৌদ্ধ ধর্মের রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন এবং ত্রিপিটক সংকলিত হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় রাজগৃহে। তৃতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ভারতবর্ষে গণরাজ্য থেকে সাম্রাজ্যের উত্তরণ পর্বে রাজা অশোকের পৃষ্ঠপোকতায়।

গণতন্ত্রের সঙ্গে কাউন্সিল শব্দটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। রাজনৈতিক দলগুলো নেতা নির্বাচনের জন্য কাউন্সিল করে থাকে। আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলন উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কাউন্সিল হয়, কিন্তু দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হতে কয়েক মাস লেগে যায়। কাউন্সিল অনুষ্ঠানের পরে দেখা যায়, কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। সে জন্যই হয়তো বর্তমানে কথাটি চালু হয়েছে কমিটি দেওয়া হবে। দুষ্টজনরা বলে থাকে, কমিটি দেওয়ার নামে চলে পদবাণিজ্য।

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নির্ধারিত হয়েছে একাত্তর সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। বাঙালিরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। কারো দয়ায় কিংবা হুইসেল বাজিয়ে এ দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশি-বিদেশি পরামর্শকদের পরামর্শে এ দেশ স্বাধীনও হয়নি, শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের অনুরাগ-অভিযোগ, আদেশ-নির্দেশ-পরামর্শ কাজে লাগবে বলে মনেও হয় না। জনবিচ্ছিন্ন, মানবিক মানসিক কল্যাণে অসমর্থ ক্ষমতালিপ্সু সুবিধাবাদী কিছু মানুষ দেশি-বিদেশি পরামর্শকদের অনুরাগ-অভিযোগকে আত্মজ্ঞান মনে করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উষ্ণ রাখেন। তাঁদের এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উষ্ণতা গণচেতনার স্তরে পৌঁঁছে না।

এ ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বুদ্ধিজীবীদের উষ্মা গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে সহায়তার চেয়ে গণমানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। তাঁরা গরম দেশে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ত্যাগে অনভ্যস্ত। টেকসই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য যৌক্তিক সমাজ সবার আগে প্রয়োজন। যৌক্তিক সমাজ ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ক্ষমতায় আরোহণের একটি অন্যতম উপায় মাত্র। তাবিজে, কবজে, মাদুলিতে আস্থা রেখে চলা মানুষ দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টেকসই করা শুধু দুরূহ নয়, অসম্ভব।

পরমতসহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম শর্ত। ভয়-ভীতিহীন সমাজ দরকার। বইমেলায় বোমা হামলার ভয় দেখিয়ে, লেখক-কবিদের হত্যা করে অথবা হত্যার হুমকি দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বাংলা ভাই-ইংলিশ ভাইয়ের মদদদাতাদের গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বক্তব্য-বিবৃতি শুনে পুরান ঢাকার গাড়োয়ানের রসিকতার কথা স্মরণযোগ্য। সাহেব আর কিছু কইয়েন না আমার ঘোড়ায় হাসব।

গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের কথার আড়ালে অনেকেই মাৎস্যন্যায় সৃষ্টির উপায় খুঁজছেন মাত্র। নির্বাচনের সময় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নির্মাণের অঙ্গীকার করে যাঁরা ক্ষমতা আরোহণের চেষ্টা করেন, তাঁরা জনগণের কল্যাণের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি করেছেন। ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে। পবিত্র ঈদের দিনে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলা, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সভা-সমাবেশে বোমা হামলা অথবা বোমা হামলার ভয় দেখিয়ে ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণ করা যায়, যা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ২১ আগস্টের বোমা হামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে যাঁরা গ্রেনেড হামলায় অভিযুক্ত, তাঁদের নিয়ে কি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মিত হবে। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের হামলার অভিযুক্তদের রাজনীতি করার সুযোগ দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকার কি দেওয়া হয়? সেলুকাস সত্যিই বিচিত্র এ দেশ। জীবনানন্দ দাশ তাই হয়তো বলেছেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই। পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’

গণতন্ত্র শুধু বুলি নয়, বাস্তব। রাজনৈতিক দলের মধ্যে, সংগঠনের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে সেই দলের শাসনব্যবস্থায় কি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়? নগদজীবী, পরান্নজীবী, পরগাছা সমাজবিচ্ছিন্ন, অসিচন্তার অধিকারী ‘ফাজিল হাওয়ায়’ ভাসা মানুষ মানুষের জন্য নয়। তারা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ, জনগণের জন্য ভয়ংকর। আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমার সাহায্যে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

লেখক: ড. মো. আনিসুজ্জামান – অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ