1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

জুলিও কুরি শান্তি পদক : বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু

তাপস হালদার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৩ মে, ২০২২

“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।” ২৩ মে ১৯৭৩, ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি পরিষদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কথাটি বলেছিলেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের সে সময়ের মহাসচিব শ্রী রমেশ চন্দ্র। সেদিন থেকেই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি পায় বিশ্ববন্ধু হিসেবে।

বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দম্পতি বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অসামান্য অবদান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোতে যখন চিকিৎসার জন্য এক্স-রে সরঞ্জামাদির ঘাটতি দেখা দেয় তখন তারা ২২০টি রেডিওলজি স্টেশন গঠন করে প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহত মানুষকে এক্স-রে করতে সাহায্য করেন।

তাদের এই অসামান্য অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে ফ্যাসিবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, মানবতার কল্যাণে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের কর্মকে স্বীকৃতি দিতে বরণীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে সম্মানিত করে আসছে।

১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের প্রস্তাব উপস্থাপিত হয় এবং পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে সর্বসম্মতিক্রমে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তি ছিল তার সারা জীবনের লড়াই-সংগ্রামের ফসল। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন ও মানবতার জন্য বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুকে এই আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ পদক প্রদান করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই মেনে নিতে পারেননি। আর যখন বাংলা ভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে তখনই তিনি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়-দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বিজয় লাভ করাসহ বাঙালির ন্যায়সংগত প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন-

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

৭ মার্চের ভাষণই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি শুধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন-

“এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।”

দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়’- এই মতবাদে পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতৃত্বকে উদ্দেশ করে বলেন-

“পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।”

তখনকার সময়ে অস্থির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।২৩ মে, ১৯৭৩ ঐতিহাসিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক শান্তি পরিষদ সম্মেলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উন্মুক্ত প্লাজায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর হাতে পদক তুলে দেয়া হয়। পদক পেয়ে সম্মানিত হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন-

“যে পটভূমিতে আপনারা বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের সহকর্মী প্রতিনিধিরা আমাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করেছেন। এই সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের, ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে বিশ্ব শান্তি পরিষদ যেমন আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, এদেশের মানুষও ঠিক একইভাবে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছেন।”

তিনি আরও বলেন-

“আমি ১৯৫২ সালে পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলীয় শান্তি সম্মেলনের একজন প্রতিনিধি ছিলাম। বিশ্বশান্তি পরিষদের ১৯৫৬ সালের স্টকহোম সম্মেলনেও আমি যোগ দিয়েছিলাম। একই সাথে এটাও আমি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, বিশ্ব শান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।”

বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ পদক হলো ‘জুলিও কুরি’ পদক। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিগণ যারা নিজদেশ কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তারাই কেবল এ পুরস্কার পেয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, চিলির সালভেদর আলেন্দে, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, চিলির কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং, সোভিয়েত ইউনিয়নের লিওনিদ ব্রেজনেভসহ আরও কিছু বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি।

বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রদত্ত ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের মূল্যায়ন। জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্মান। এ মহান অর্জনের ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু থেকে হয়েছেন বিশ্ববন্ধু। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এ পদক ছিল বিরাট এক সাফল্য। এ পদকপ্রাপ্তি আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশকে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার দ্রুত স্বীকৃতি পেতে বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

যতদিন বিশ্বে জাতি, সম্প্রদায়, ধর্মে-বর্ণের সংঘাত তৈরি হবে ততদিনই বঙ্গবন্ধুর দর্শন, কর্ম, আদর্শ ও মানবতাবোধ অসহায় মানুষের কাছে প্রেরণা হয়ে শক্তি জোগাবে। তিনি তার কর্ম দিয়ে হাজার বছর মানুষের মাঝে শক্তি হয়ে থাকবেন। আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির দিন। এই দিনে বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, মহান স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি রইল অবনত মস্তকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : তাপস হালদার – সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা। haldertapas80@gmail.com


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ